বুয়েনস এইরেসে কোনো বিশিষ্টজনের মৃত্যু হয়নি। তবু আর্জেন্টিনার রাজধানী বিয়োগব্যথায় আক্রান্ত! বুয়েনস এইরেসের মানুষের এই ব্যথা ডিয়েগো ম্যারাডোনার জন্য। আর্জেন্টিনার ফুটবলের সঙ্গে ম্যারাডোনার সম্পর্ক-বিয়োগ মেনে নিতে পারছে না কেউ। সাধারণ মুদিদোকানি থেকে শুরু করে প্রেসিডেন্ট—ম্যারাডোনাকে বিদায় করে দেওয়াটা মানতে পারছে না কেউই।
আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ শেষ হয়েছে কোয়ার্টার ফাইনালে জার্মানির কাছে ০-৪ গোলে হেরে। দল নিয়ে দেশে ফিরে কোচ ম্যারাডোনা বলেছিলেন, আমার দিন শেষ। কিন্তু আর্জেন্টিনার সাধারণ মানুষের সঙ্গে প্রেসিডেন্ট ক্রিস্টিনা কির্চনার পর্যন্ত কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে বলেছিলেন—থেকে যাও ডিয়েগো। একই সুর ছিল আর্জেন্টিনার ফুটবল ফেডারেশনের (এএফএ) সভাপতি হুলিও গ্রন্দোনা আর ম্যানেজার কার্লোস বিলার্দোর মুখেও।
তবে সময়ের সঙ্গে বদলে গেছেন গ্রন্দোনা আর বিলার্দো। ম্যারাডোনা সংবাদ সম্মেলনে করে বলেছেন, গ্রন্দোনা আর বিলার্দো তাঁর সঙ্গে মিথ্যাচার করেছেন, করেছেন প্রতারণা আর বিশ্বাসঘাতকতা। মুখে তাঁকে থেকে যেতে বললেও নাকি দুজনের একজনও চাননি ম্যারাডোনা আর্জেন্টিনার কোচ থেকে যান। দুজন মিলে ষড়যন্ত্র করেই ম্যারাডোনাকে দ্বিতীয় দফায় আর্জেন্টিনার কোচ করেননি!
আর্জেন্টাইন ‘ফুটবল-ঈশ্বরের’ সঙ্গে এমন আচরণ মেনে নিতে পারছে না সে দেশের মানুষ। এক মুদিদোকানে কাজ করেন ৩৩ বছর বয়সী ফেদেরিকো গার্সিয়া। রাজনীতি বা ভালো কোচ-মন্দ কোচ কাকে বলে বোঝেন না তিনি। কিংবা বুঝতেও চান না। তিনি শুধু বোঝেন এমন একজন কিংবদন্তির সঙ্গে এএফএর এই কাজটা করা ঠিক হয়নি। ‘তিনি একজন আইকন। এমন একজন মানুষের বিদায়টা আরও মার্জিত হতে পারত’—বলেছেন গার্সিয়া।
আর্জেন্টিনাকে ১৯৮৬ বিশ্বকাপ জিতিয়ে মানুষের হূদয়ে ঈশ্বরের আসন নিয়ে বসেছেন ম্যারাডোনা। দক্ষিণ আফ্রিকা বিশ্বকাপের আগে আর্জেন্টাইনরা স্বপ্ন দেখেছিল—ম্যারাডোনা তাদের আবার শিরোপা এনে দেবেন। সেটা হয়নি, বিশ্বকাপ থেকে ব্যর্থ হয়ে ফিরেছেন তিনি। তবে আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ পারফরম্যান্সে অখুশি নয় দেশের মানুষ।
একটি পত্রিকা বিক্রয়কেন্দ্রের মালিক ক্লদিও ইয়াগো করলেন ম্যারাডোনা এবং আগের কোচদের তুলনামূলক বিচার, ‘কোচ হিসেবে তিনি খুব একটা খারাপ করেননি! ১৯৯০-এর পর আমরা কখনোই কোয়ার্টার ফাইনালের বাধা পেরোইনি। তাই আমার মনে হয় না অন্যদের তুলনায় তিনি কিছু খারাপ করেছেন!’
বিমাপ্রতিষ্ঠানের পরামর্শক সিমন লাম্পার কাছে ম্যারাডোনার ক্ষেত্রে এসব হিসাব-নিকাশ শুধুই বাতুলতা, ‘কোচ হিসেবে তার অনেক কিছুর অভাব থাকতে পারে, কিন্তু এটা ব্যাপার নয়। কারণ তিনি “এল ডিয়েগো”। আমি জানি, আর্জেন্টনায় অনেক ভালো কোচ আছে। তাতে কী? ম্যারাডোনা একটি আদর্শের নাম।’
ম্যারাডোনার বিদায়ে শোক সবচেয়ে বেশি ছুঁয়েছে বুয়েনস এইরেসকে। এই বুয়েনস এইরেসের লানুসেই তাঁর জন্ম আর বেড়ে ওঠা। লানুসের বস্তি থেকেই বিশ্ব ফুটবলের মহান তারকা হয়েছেন ম্যারাডোনা। বুয়েনস এইরেসের মানুষ একেবারেই মেনে নিতে পারছে না আর্জেন্টাইন ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের সিদ্ধান্ত। ব্যাপারটাকে তারা দেখছে ‘নোংরামি’ হিসেবেই, ‘আমরা ম্যারাডোনাকে ভালোবাসি। আমার মনে হয়, এএফএর প্রধান ছলচাতুরী করে তাকে বের করে দিয়েছে।’
বিশ্বকাপ শেষে ম্যারাডোনার দেশে ফেরার দিন যেমন সবার কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়েছিলেন প্রেসিডেন্ট কির্চনার, এবারও তাই করেছেন। সবার কষ্টই যেন ঝরে পড়েছে তাঁর কণ্ঠে, ‘তার (ম্যারাডোনা) বিদায়ে আমি খুব দুঃখিত।’ এএফপি, ওয়েবসাইট।